প্রকাশিত: Tue, Dec 20, 2022 3:32 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 12:29 PM

বাম হাত দিয়ে কান্না মুছেছি নীরবে, কিন্তু আশা হারাইনি

নিঝুম মজুমদার

১৯৮৮ সালের বন্যার পানি বাড়ছে বাড়ছেÑ এমন একটা সময়ে বাবা ফিলিপসের ২১ ইঞ্চি একটা শাদা কালো টিভি কিনে নিয়ে আসলেন নৌকায় করে। এখনো মনে আছে সেই নৌকা চালকের নাম। কাদের। ওই টিভি কেনা পর্যন্তই। কোনোদিন আরাম করে সেই টিভিটা দেখতে পারিনি। টিভি দেখা আমাদের বাসায় অনেকটা নিষিদ্ধই ছিলো। বাবা রাতে খবর দেখতেন চেম্বার থেকে ফিরে। আমরা লুকিয়ে তাই দেখতাম। চুরি করে কিংবা লুকিয়ে যাই বলিনা কেন, ১৯৯০ সালের বিশ^কাপই নিজের বাড়িতে বসে প্রথম বিশ্বকাপ দেখা। তাও আর্জেন্টিনার ম্যাচগুলো। বাবা দেখতেন তাই সেই চুরি করে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিলো।

আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচটা ছিলো ক্যামেরুনের সঙ্গে। ম্যারাডোনা ম্যাচ শুরুর আগে বল নিয়ে কসরত করছেন, এখনো চোখে স্পস্ট লেগে আছে। সেই থেকে আমার আর্জেন্টিনা ভ্রমণ শুরু... বাবার ভয়ে সব খেলা দেখা হয়নি। ওই লুকিয়ে, চুরি করে যেটুকু দেখা যায়, সেটুকুই...। ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনাকে ডোপ টেস্টে নিষিদ্ধ করার পর কেঁদেছি। তখন ফিফার প্রেসিডেন্ট ছিলো খুব সম্ভবত হ্যাভেলাঞ্জ নামের কেউ। কী যে গাল-মন্দ করেছি, বলার মতন নয়। গ্রীস আর নাইজেরিয়ার সাথে জিতে যাবার পর ৩ নাম্বার ম্যাচের আগে এই অঘটন। ১৯৯৮ সালে গভীর রাতে বাসার পাঁচিল টপকে জুলহাস ভাইদের বাসায় টিভি দেখেছি। উনাদের টিভিটাও ছিলো ছোট। কিন্তু সে সময় সেটাই ছিলো আলাদীনের চেরাগের মতন বিস্ময়কর। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপ পর্যন্ত সব ইংল্যান্ডে বসেই দেখা। ২০১৮ সালে তো আমি নিজেই রাশিয়া গিয়েছি বিশ্বকাপ দেখতে।

এরই মধ্যে সময় গড়িয়েছে অনেক। বাবা যাতে শুয়ে শুতে আরাম করে টিভি দেখতে পারেন, তাই তাঁর রুমে বিশাল এক টিভি কিনে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার আর টিভি দেখবার সেই ইচ্ছে মরে গেছে কবে। বয়সের কারণেই বোধকরি...। ২০২২ সালের বিশ্বকাপটাতে যেন নতুন করে শৈশব আর কৈশোর ফেরত চলে এসেছিলো। প্রথম রাউন্ড দেখেছি ঢাকায় বসে। এলিফ্যান্ট রোড থেকে প্রজেক্টর আর স্ক্রীন কিনে নিয়ে এলাম। বন্ধু-বান্ধব সহ বড় আয়োজন করে দেখতে বসলাম। বিধিবাম। প্রথম ম্যাচেই সৌদির কাছে বিস্ময়কর পরাজয় আর্জেন্টিনা। তারপরও আশা হারাইনি। ইনফ্যাক্ট আমরা আর্জেন্টিনা দর্শকেরা এক অদ্ভুত দর্শক। আমরা আমাদের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন আর্জেন্টিনার জন্য দিয়ে দিলাম কিছু না পেয়েও। কিন্তু আশা হারাইনি একটিবারের জন্য।

আমরা কেঁদেছি। আমরা ব্রাজিলের সমর্থকদের ট্রল সহ্য করেছি। শক্ত করে একহাত দিয়ে আরেকহাত চেপে ধরে রেখেছি। বাম হাত দিয়ে কান্না মুছেছি নীরবে কিন্তু আশা হারাইনি। প্রাচীন মিথ বলে, সবারই দিন আসে। এসেছে। আমাদের দিন এসেছে। মন্টিয়ালের শেষ কিকটার পর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়েছে। কুশনে মুখ চেপে ধরে মনের আনন্দে কেঁদেছি। আমার স্ত্রী পরম মমতায় পিঠে হাত দিয়ে রেখেছে। এমন আনন্দের দিনে কাঁদতে হয় বোধকরি...। ইচ্ছে ছিলো। আর্জেন্টিনা জিতলেই লন্ডন থেকে বুয়েন্স আইরেসের টিকেট কিনে ডাইরেক্ট আর্জেন্টিনায় চলে যাব। নানান বাস্তবতায় হচ্ছে না এইবার। তবে যে ঘোরের মধ্যে বসে আছি, এই ঘোর কাটতে বহু বহু বহুদিন লেগে যাবে। এটা নিশ্চিত। ফেসবুক থেকে